আতাগাছ
মাঝরাতে সবকিছু ডুবে যায়।
নিয়নের আলো শুষে জেগে থাকে শুধু
তরফদারের আতাগাছ।
তাতারদস্যু ও ফুলগাছচোর ইতিবৃত্ত
[একেকদিন তাতারদস্যুদের কথা শুনতে শুনতে আমি বিহ্বল
হয়ে যাই। তারা গরিব আকন্দফুলের শাড়ি খুলতো না, চন্দ্রমল্লিকা
মাড়িয়ে যেত না…তবু তারা দস্যু ছিলো!]
আমাদের ভৃত্যটির গায়ে উত্তপ্ত কড়াই থেকে তেলের ছিটে
এসে লাগে। পার্শ্ববর্তী নার্সারি থেকে শেকড়সহ অনেক ফুলের
গাছ চুরি হয়ে যায়, নিয়মিত।
বিকেলের হীরে-হীরে রোদে সেদিন লাল-শাদা দু’টি হাঁস
চরছে নদীতে, চোরেদের জড়ো করা হলো।
শিশু থেকে শুরু করে অনেক প্রেমযুগল, নীল একটি
সালোয়ার-কামিজ, এসে বসলো।
খাকি-পরা মোটাসোটা অফিসার আর ভ্যাবলাকান্ত কনস্টেবল।
অফিসার খুব তৎপর হয়ে উঠলেন। কিন্তু তার সামনেই কক্ষের
ভেতর বিদ্রূপস্রোত ভেসে যেতে লাগলো।
ভোর
ভোর দেখি লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে।
থ্যাতলানো ফুল, কাদায় লুটোপুটি।
চাকাচিহ্ন চলে গেছে দূরে, অন্ধকারে।
ওড়ে উড়ুক্কু মাছ, একটি… দু’টি…
তাবরেজীর সাথে একটি বিকেল
বেলতলার রাস্তায় বেরিয়েই তাবরেজীর সাথে দেখা। গাঢ় হলদে
ছাপা শার্ট গায়ে তাবরেজীও দেখি বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছেন।
আমি তাঁকে ধরে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসি। আমাদের বাড়িটা
অন্ধকার-অন্ধকার, খাট-টেবিল বাচ্চা-কাচ্চা কাপড়-চোপড় হৈচৈ’এ
ঠাসা। তাবরেজী অর্ধেক-করে-কাটা মিষ্টির একটা মুখে দেন।
স্বপ্নাকে বলি তাবরেজীকে সে চেনে কিনা। স্বপ্না ঠোঁট টিপে একটু
মুখ বাঁকায়। আমি একটু হতচকিত হয়ে তাবরেজীর দিকে তাকাই।
তাবরেজীও দেখি তাই করেন। তখন আমি স্বস্তি পাই। চা-টা খেয়ে
আমরা আবার বাইরে বেরুই। দেখি সেটা আমাদের বাড়ি ছিলো না।
সেটা ছিলো খুকুদের বাড়ি। আমার বোন খুকু। যে এখন হসপিটালে।
কয়েকদিন আগে যার স্ট্রোক করেছে।
আমি আর তাবরেজী বড় রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটি। আমার পরনে
নতুন কেনা লুঙ্গিটা। এখনো অনেকখানি ফুলে আছে। আমি বলি,
কবে এসেছেন যশোরে? তাবরেজী বলেন, পরশু। ক’দিন থাকবেন?
আরো তিনদিন। বুঝি তিনি অফিসের কাজে এসেছেন। তাবরেজী
সন্ধ্যায় মদ্যপান করবেন কিনা ভাবি। একটু পরেই তাবরেজী পকেট
থেকে কিছু একটা বার করে আমার হাতে দেন। দেখি ছোট-বড়
চারটা কয়েন। তামাটে, রুপালি, সোনালি, হালকা সোনালি। আমি
বলি এগুলো আমার ছেলেকেই দিতে পারতেন। ও খুব খুশি হতো।
তবে এই কয়েনগুলো সবই তার আছে। সেকথা তাবরেজীকে বলিনা।
আমরা একটা রিকশা নিয়ে নিউমার্কেট রোড হয়ে ঢাকা রোডের ব্রিজের
ওপরে আসি। এই ব্রিজটা দেখি সমুদ্রের উপর দিয়ে চলে গেছে। তবে
সমুদ্রটা একটা বড় নদীর মতোই। আমরা রেলিঙ ধরে ঝুঁকে দাঁড়াই।
ব্রিজের নিচ দিয়ে অসংখ্য বিশাল বিশাল সব মৎস্য চলে যাচ্ছে। আরো
বহু জিনিস ভেসে যাচ্ছে। কিছু বিশাল মাছের শরীরের অল্প-অল্প দেখা
যাচ্ছে। একখণ্ড হালকা জলজ মাঠ আড়াআড়ি ভেসে যাচ্ছে। তাতে ফুল
আছে। কিছুটা লাল শাপলার মতো, তবে তাকে সিঙ্গল শাপলা বলা যায়।
আমি অথইকে ডেকে দেখাই। অথই (আমার বালক ছেলে) তার এক
ন্যাংটো বন্ধুর সাথে ন্যাংটো হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। ওই দু’জনও কখন
জানি আমাদের পেছন পেছন চলে এসেছে। ব্রিজের ওপর, এদিক-ওদিক,
আরো লোকজন আছে। কলেজ পড়ুয়া ছেলেরাই বেশি। তারা ভালো।
মাছের সাথে সাথে দেখি একটা অদৃশ্য পাটাতনের ওপর বিরাট বিরাট
শাদা শাদা আকৃতির হাত-পা-মুণ্ডু-কেড্স ভেসে যাচ্ছে। তাবরেজী বলেন,
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বানাইছে। বুঝি এইটা কোনো বিজ্ঞাপন।
আমরা ফেরার জন্যে রিকশাটা খুঁজি। সেটাকে কোথাও দেখা যায় না।
তবে সেটা তেমন কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
তাবরেজী দেখি ব্রিজের পাশ দিয়ে নেমে সমুদ্রের পানিতে নেমে গেছেন।
ব্রিজের নিচে ইটবাঁধানো পাড়ের দিকে যে মাছগুলো চলে আসছে
সেগুলোর বেশিরভাগই বিশাল বিশাল বোয়ালের মতো। সেখানেও
দেখি একটা অদৃশ্য পাটাতনের ওপর রাখা বিশাল বিশাল সব
মৎস্যআকৃতি ভেসে যাচ্ছে। তার সাথে হাত-পা ইত্যাদির মিল
আছে। তবে এগুলো একটু লালচে ধরনের। আমিও তাবরেজীর
সাথে পানিতে নেমে পড়বো কিনা ভাবছি। মাছগুলো কামড়ে দেবে
কিনা ভাবতে ভাবতেই দেখি তাবরেজী একটা পাঁচ ফুট বোয়ালের
মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে যুদ্ধ করছেন। অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পর
তাবরেজী বোয়ালটার মুখটা দু’হাত দিয়ে বিরাট হাঁ করে ধরেন।
ভেতরে বৃত্তাকার দুইসারি ক্ষুদে ক্ষুদে কালো কালো দাঁত দেখা যাচ্ছে।
তাবরেজী বলেন, এই দাঁতগুলোই সমস্যা। তারপর একটা দা দিয়ে
মাছটার পিঠে একটা কোপ দিয়ে সেটাকে গেঁথে ফেলেন। আমাকে
বলেন, অথইকে বলুন মাছটাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। স্বপ্নার যদিও
রাতে মাংস রাঁধার কথা কিন্তু আজ বোয়ালটাও সে রাঁধতে পারবে
ভেবে আমার একটু খুশিই লাগে।
তবে আমি মনে মনে এও ভাবতে থাকি, মাছটা এভাবে নেওয়াটা বৈধ
হবে কিনা। কারণ মাছটা তো সরকারি। এরকম হলে তো এই সমুদ্রে
আর কোনো মাছই থাকার কথা নয়। মুহূর্তেই সব সাফা হয়ে যাবার কথা।
হামাম
তারা বললেন, ‘জলপরীদের সাথেও স্নান করা যায়,
তবে সেইক্ষেত্রে দুই টঙ্কা বেশি লাগবে।’
টঙ্কার গায়ে বাদশা সলোমনের মোহর। মোহরের
ভেতর ভগ্ন প্রাসাদের একফালি। এই প্রাসাদের গায়ে
হেলান দিয়ে সাইকেল রেখে বাদশা সলোমন হাওয়া
হয়ে গেলেন।
শিশুদের সাথেও জলকেলি করা যায়। সেইক্ষেত্রে
একটা করে নরবলি দিতে হয়।
তবে সবচে’ সহজ উদ্বিড়ালদের সাথে জলকেলি।
পশ্চিম উপকূলে এখন শুধুই উদ্বিড়াল আর উদ্বিড়াল।
কোস্টগার্ডরা ছাড়া আজকাল সেখানে আর কেউই
যায় না।
আগুন
বুঝছি যে ম্যাজিক, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছি না।
প্রথমে ধোঁয়া উড়তে শুরু করছে, তারপর সেই ধোঁয়া গাঢ়
আর দ্রুত হয়ে উঠছে।
বুককেসের পাটাতনে তো হলুদ আগুনই জ্বলে উঠলো!
ঠিক যে রকম ভয় পাচ্ছিলাম। তারপর অবশ্য নিভেও গেল,
পুরোপুরি।
সবচেয়ে সুন্দরী আর লাস্যময়ী যে মেয়েটা বসে ছিলো, সেই
দেখাচ্ছিলো খেলাটা। আরো দু’টি মেয়ে ছিলো ঘরে। তারা অবশ্য
মোটেও অবাক হচ্ছিলো না।
লাইব্রেরির মতো বড় ঘরটার যেখানেই মেয়েটা তাকাচ্ছিলো
সেখানেই ধোঁয়া উড়তে শুরু করছিলো। স্যান্ডেলের পেছনে,
পিরিচের পাশে, টেবিলের ওপর, সর্বত্র।
বুঝছিলাম যে ম্যাজিক, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না।
পদ্ম
এসব কথার কোনো অর্থ নেই, তবু আমরা গুপ্তধন
চাইলাম। নীল জামের অন্তর্শাঁস চুইয়ে যেতে
চাইলাম গোলাপি মায়ার দেশে।
মানুষের এতো মোহ!
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেনলাইন গেল,
গুপ্ত কলাবতীর কয়লাপাহাড়ের পাশ দিয়ে কাশফুলের
দিগন্ত দেখা গেল। তবু আমাদের দুঃখ গেল না।
লাল-হলুদ মরিচের মতো লক্ষ বৃষ্টিদানায় ভরে গেল
উঠোন, ক্ষেত, প্রান্তর।
সেই থইথই প্রান্তরে একদিন এক অলৌকিক পদ্ম
ফুটবে বলে আমরা আশায় আশায় রইলাম।
লাল মোরগের মতো গলা ফুলিয়ে আমাদের প্রতিবেশীরা
সেই থইথই প্রান্তরের দিকে আড়ে আড়ে চাইতো।
অন্ধসাপের মতো কোনো এক পদ্মকুঁড়ি একদিন হঠাৎ
সেই জলরাশি ফুঁড়ে উদয় হবে, উদয় হবে বলে।
মুস্তফা
(কবি মুস্তফা আনোয়ার, শ্রদ্ধাস্পদেষু)
হঠাৎই মনে হয়, আরে, এটা তো তুমিই! সকলের মাথা ছাড়িয়ে,
ধূসর বেগুনি ওভারকোটের ভেতরে, অন্ধচশমায় ঈষৎ কৌতুক তুলে,
তুমিই তো বার দুই হেঁটে গেলে বুলেভার্ড দিয়ে।
একবার ওদিক থেকে এদিকে, একবার এদিক থেকে ওদিকে।
কৃষ্ণচূড়ার অন্ধকারে একাকী রিক্সায় আমি ধীরে ধীরে সেলফোন
ঢুকিয়ে দেই তোমার পাঁজর বরাবর। দোতলায় মেহগনি কাঠের
চেয়ারের ওপর থেকে তোমার উল্লসিত কণ্ঠ শোনা যায়, ‘এই, আমি
বাসায়, কী করবো?’
আশ্চর্য, তবে সেই বেগুনি ওভারকোটের অন্ধচশমা লোকটা? তার
ভেতরে বসে বসে তুমি কেন হেঁটে গেলে বার দুই বুলেভার্ড দিয়ে?
দোয়াত
আমরা বস্তুতে বিশ্বাস করি না।
ইদানীং বস্তুহীনতাতেও বিশ্বাস নেই আর।
তবুও টেবিলটা রয়েছে।
টেবিলের ওপর রয়েছে ফুলদানিটা।
একটা দোয়াত যদি থাকতো টেবিলটার ওপর!
কাচের দোয়াত।
বিশাল পুরু তার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যেত
উঠোনে হেঁটে যাওয়া বৃদ্ধের শাদা দাড়ির আভাস।
চকিতে চলে-যাওয়া লালশাড়ি বউয়ের লালের আভাস।
গুহা
যখন আকাশ ভেঙে পড়ছিলো আর মাঝে মাঝে
জলপ্রপাতের আয়না এসে ঝিলিক দিচ্ছিলো
আমাদের বদ্ধ চোখে, নৈরাজ্যের শব্দে এফোঁড়-ওফোঁড়
হয়ে বহু ওপরে উথলে উঠছিলো সমুদ্র…,
তখন আমরা বসেছিলাম গুহার ভেতর এলোমেলো
পাথরের ওপর, শ্বাপদ ও সরীসৃপ, স্থির আর জড়সড়।
একটি মথ শুধু একবার উড়ে গিয়েছিলো এদিক থেকে
ওদিক আর আমরা সকলেই ছিলাম অপেক্ষমাণ,
চিত্রতারকাময়, অন্ধকার গুহায়।