হলুদ পাখিটি আজ নিবিড় সকালে এসে জানালার কাচে কাচে তার সনীড় সতত ঠোঁটে ঠোকর দিয়ে দিয়ে ভেঙে দিলো সন্ধ্যাসবের মতো ঘুম। খুব বিরক্তি সমেত বিপুল বিক্ষেপে আমি চোখ মেলে দেখি, তারপর মাথা তুলে পাখিটির দিকে চেয়ে থাকি, থাকি সমূহ শঙ্কার রোদ-ঘুমঘুম ভোরে। দেয়ালের দেবালয়ে দেখা গেল শুদ্ধতাকামী আগুন, পাখিটি এবার হেসে ফেলল। তার ঠোঁটের ভেতর থেকে ছোট ছোট কীসব হলুদ হলুদ দানা বের হয়ে আসতে থাকলো, থাকলো প্রণয়শালী কতিপয় ফলকলিপি। দানাগুলো নিজ নিজ আড়ালে বিক্ষিপ্ত নাচের খেয়ালে ভেসে গেল দৃশ্যাতীত কোথাও। তারপর, ঠিক মধ্য আশ্বিনে, বাতাসের সাথে নাচা ধানগাছের মতো ভঙ্গি নিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে। হলুদ দানাগুলো গড়াতে থাকলো একসময়, যেন দেহাতীত আত্মাগুলোর সলীল সাঁতার। গড়াতে গড়াতে আগুন নয়, একেকটি পাখি হয়ে গেল। তারাও ঠোঁট দিয়ে অদৃশ্য কাচে ঠোকর দিতে থাকলো। কিন্তু নেই কোনো কাচগন্ধী শব্দ। একধরণের রিনিঝিনি শব্দে ভরে গেল চারপাশ, ভেসে গেল চারপাশ।

এই শব্দ সদ্য-কিশোরীর লাজুক রিনিঝিনি হাসির শব্দ কি-না তা ভাবতে-না-ভাবতেই দেখলাম পাখিটি খুব দুপুর হয়ে যাচ্ছে। আর মধ্য দুপুরের ছায়াহীন টই টই হলুদ-কুড়ানী হয়ে খুঁজে ফিরছে আমাকে।

দুই

হলুদ-কুড়ানী তিনি, হাতে তাহার একটি খাতা। তিনি, হলুদ-কুড়ানী- আঙুলের মুঠি শক্ত করে ধরে ধরে পাতাগুলো দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। যখনই ছেড়ে দিচ্ছে তখনই সেগুলো হয়ে যাচ্ছে আবার আগের মতো। হলুদ-কুড়ানী বিস্মিত নয়নে চেয়ে চেয়ে তা দেখছে। হাত দিয়ে চোখ রগড়াচ্ছে। তারপর আবার সোৎসাহে আরো শক্তি প্রয়োগ করে দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে ফেলছে। কিন্তু পাতাগুলো ঠিক আগের মতোই সোজা হয়ে যাচ্ছে। টানটান হয়ে যাচ্ছে। হলুদ-কুড়ানী আবারো বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে পাতাগুলোর দিকে। এবার দেখা গেলো পাতা থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ছে সবুজ শিশির।

শিশিরের ফোঁটাগুলো যখনই মাটিতে পড়ছে, দেখা যাচ্ছে সেগুলো নিছক রঙহীন জলীয় জলজ। সেগুলো প্রাণ পাচ্ছে। প্রাণ পেতে পেতে তারা পুনরায় কাগজের পৃষ্টায় চলে আসছে। হলুদ-কুড়ানী এবার একটুও বিস্মিত না হয়ে পাতাগুলোকে অর্থহীনভাবে আরো সোজা মসৃণ করতে চাচ্ছে। তখনই পাতাগুলো হলুদ সুবজ আর কালোর মিশেলে ডোরাকাটা দাগ হয়ে উঠছে। কাগজগুলো নড়তে নড়তে হয়ে উঠলো সুন্দরবনের বাঘ।

হলুদ-কুড়ানী দেখলো এই বাঘ নিছক হলুদের আবছা অন্ধকার নয়। নয় পাতার রক্ত মাংসহীন রুলটানা দাগ। এই বাঘ কাগজ-অতিক্রান্ত কোনো এক কাগজের নির্দেশনা।

ভাবল, এবার একটু দৌড় দিতে হবে। কিন্তু কে জানে না, শৈশবের দৌড় বেশি দূর যেতে পারে না।

তিন

হলুদ-কুড়ানী তবুও দৌড় দিলো। দেখলো পাকা পাকা ধানের শিষ। দিগন্ত জোড়া সে-শিষের কোনো শেষ নেই। নেই কোনো জমির বিভাজক চিহ্ন- যা সরু রাস্তা করে দিতে পারত হলুদ-কুড়ানীকে। কিন্তু কাগজ অতিক্রান্ত বাঘ রক্ত মাংশীয় হয়ে গর্জন করা শুরু করছে। আর ধেয়ে আসছে তার পিছু পিছু। তাই বাধ্য হয়ে হলুদ-কুড়ানী সোনালী শিষের সাগরে পা বাড়ালো। অমনি হয়ে গেলো এক সরু রাস্তা।
হলুদ-কুড়ানী ভাবল- পা বাড়ালে রাস্তা বের হয়। কিন্তু রক্ত মাংসের বাঘ কী কাগজের হয়ে যায়!

 

Error: View fb876cfshl may not exist

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *