সীমান্তের কাছে বসে আজও স্ট্যাটাস দেয় সাম্য, আর আমি তার মুখে দেখি আপন-আদল; যত দেখি সাকুরা-সুরার মতো ততই ডুবে যাই আপনেই।
অন্যদিনের মতন সেদিনও আড্ডায় মুখর ছিল আজিজ-চত্বর। শাহবাগ-মোড় থেকে কাঁটাবন- জোনাকির রূপ ধরে কিলবিল করছিল অন্যপোকারা। সেদিনও সংসার-তাড়া-খাওয়া মানুষের তাড়া ছিল; তাড়া ছিল আমাদেরও- কখন জুটবে সবাই?
শরৎ-মেঘের মতো অবসর হাতে সেই সুবর্ণ সন্ধ্যায় অশোকের সাথে অজস্ত্র বইয়ের সুগন্ধে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অদূরে বিজয় রুদ্র সুজন মামুন তানজিমসহ শূন্য-র কবিরা- যারা প্রতিদিন প্রতিশ্রুতির স্বাক্ষর রাখছে, ছোট-ছোট-কাগজে আঁকছে বড় হওয়ার স্বপ্ন।
হৃদয়ে হলুদ ডাকটিকেট নিয়ে তখনও মাসুদ অফিসে, পরদিনের ফিচার-পাতাটা প্রেসে ধরিয়ে তবেই রিকশায় উঠবে, সাতমসজিদ রোড ধরে ছুটবে এই অভিমুখে। ধূলি ও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন আজিজ চত্বর, তবু আমাদের দুজনের আঙুলের ফাঁকে তার জন্যে অপেক্ষমান সিগারেট।
সংলগ্ন ফুটপাতের ব্যস্ত পথচারীদের ভিড়ে এক অব্যস্ত বিনয়ী ও ভয়াবহ ভদ্রলোক ধূলি-ধোঁয়ামেঘ ভেদ করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে জানায়, আমি আপন মাহমুদ, চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। ওখানকার তরুণ কবিরা আপনাদের কথা বলেছেন…; সারাদিন শাহবাগ ঘুরেও আজিজ মার্কেট পাইনি। গণগ্রন্থাগার-সিঁড়িতে বসে কত কী ভেবেছি, টুকেও রেখেছি তার কিছু কিছু মলিন কাগজে। এই ঝোলাব্যাগ আর গোল্ডলিফ ছাড়া এ-শহরে কেউ আমাকে চেনে না, আমিও চিনি না। শুধু কজন কবিকে জানি, যাদের নিকট আমি পৌঁছুতে চাই…
কবিতার পাশাপাশি আরো এক মানবিক জেদ কাজ করেছিল মনে। সেদিনই আপন করে নিয়েছিলাম- নিয়েছিলাম তার সমূহ দায়িত্ব। এমন ছন্নছাড়া ভবঘুরে কত যে বেকার এসেছে আমাদের কাছে… কবিতার সাঁকো বেয়ে মিলেছে- মিলেছি আমরাও। অনেকেই করে গেছে ভীষণ শত্রুতা- ক্রমাগত চাল চেলে কত যে মেখেছে কুড়ো- চুনকালি বন্ধুতার মুখে! নিন্দুকের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ করে গেছে কেবল বিষেদগার। তারা খেয়ে-প’রে বেশ আছে… অথচ আপন, যার বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ নেই, ফিরবে না জেনে চলে গেছে সকলের প্রস্থানের আগে।
সাম্যকে আপন ভেবে বসে থাকি কেন? সে-ও কবি- ভেতরে-বাইরে, পূর্বে ও পরে। আপনের মতো সেও সকল শংকা তুড়ি মেড়ে ফুৎকারে বাতাসে উড়িয়ে দেয়, বলে, ‘কবিতাই আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে’। দীর্ঘশ্বাসে জীবনানন্দ ধার ক’রে বলি, বধু শুয়ে আছে- পাশে শিশুটিও… তবু আমি অঝোরে কাঁদছি- কেউ জানে না… অনর্জালে মুহূর্তে ধরা দেয় দ্বিধাহীন সহজ উত্তর: বোকাপাখি কাঁদতে জানে না, একশব্দ থেকে লাফ দেয় অপর শব্দের দিকে…
সেই লাফালাফিই কি ঘুমোতে দেয় না- জাগাতে-জাগাতে কেবল নিয়ে যায় দীঘল ঘুমের শেষপ্রান্তে?