সরলরেখার শেষবিন্দু পর্যন্ত বাবা জোর কদমে চলতেন। তারপর আর বক্ররেখায় এগিয়ে কারো ঘরে আশ্রয় চাইতেন না। অথচ মাথার আধাহাত উপর দিয়ে যে ছাতাটা বয়ে বেড়াতে দেখেছি, তার ছায়া কখনোই দীর্ঘতর হতো না।
বছর বছর আমাদের জামা-কাপড় ছোট হয়ে শরীর থেকে নেমে যেত, দুই পা কামড়ে ধরত পুরনো জুতো। আমরা বাবার পা কামড়ে গুটিসুটি হয়ে পড়ে থাকতাম ছাতাটির ক্ষুদ্র ছায়ায়।
সেই থেকে অন্তত একটা বড় আকারের ছাতার প্রয়োজন ছিল। যেটির ছায়ায় ছোটখাট রাজসিংহাসন থাকবে বাবার জন্য। আমরা সবাই সেখানে ঘিরে দাঁড়াব।
কেবল একটিমাত্র বড়ছাতা বছর বছর খুঁজে বেড়িয়েছি স্কুলের কক্ষে কক্ষে, খেলার মাঠে আর মহাবিদ্যালয়ে। সাথে বাবার ছাতার মাপ থাকত টুকরো-কাগজে। এবড়ো থেবড়ো কিংবা পিচপথে শক্ত জুতোয় ভর করে, বাসে ঝুলে ঝুলে গিয়ে তকতকে সাহেবদের সামনে ঘর্মাক্ত মুখ নিয়ে আনাড়ি চোখে এদিক-ওদিক ছাতা খুঁজেছি, শুধু একটি বড় ছাতা।
বৃষ্টি চেয়ে আষাঢ়ের আকাশের নিচে গিয়ে বারবার সৌরসেদ্ধ হই। ঘরকুনো ইঁদুরের মতো বাবার ছাতার নিচে ফিরে আসি ফের। প্রতিবছর এরকম ছলনার আষাঢ় আসে। সংকল্পবদ্ধ রোদ আর নির্বোধ ভারী বর্ষণ আকাশ ছিঁড়ে নামে; ছাতার দেখা কিন্তু মেলে না।
এযুগে ছাতাগুলো সব মায়াহরিণ। সেকেন্ডে সেকেন্ডে জোরকদম এগিয়ে চলি সরলরেখা বরাবর; শেষবিন্দু মেলে না, মেলে না। বক্ররেখার আধিপত্যের যুগে দৈনিক পত্রিকায় নতুন নতুন জ্যামিতিক সমাধান ছাপা হয়। কেবল সরলরেখা আজো অতীত অথচ কী অস্পৃশ্য! বাবার সরলরেখা কী অদ্ভুত অস্পৃশ্য!