মানুষের কথায় আমি আজকাল হাসি
ঠিক বাবার মতো।
বাবাকেও কেউ কিছু বললে তিনি হাসেন।
হাজার কটু কথা বললেও চুপ করে থাকেন।
ছোটবেলায় ভাবতাম তার কি লজ্জা করে না?
গায়ে ছাল চামড়া নেই নাকি তার?
একটা মানুষ এতো কথা বলছে আর তিনি নির্বিকার।
অটল মূর্তির মত শুধু শুনছেন তো শুনছেন!
বাবাকে খুব কম মানুষের উপর রাগতে দেখেছি।
খুবই কম মানুষের উপর!

যেবার তিনি ব্যবসায় লস খেয়ে আমার পড়া বন্ধ
হবার উপক্রম,
বাবা তখন নির্বিকার ভাবে দোকান থেকে এসে
বলেছিলেন- “পড় বাবা, মন দিয়ে পড়। সামনে না তোর পরীক্ষা!”
প্রচুর কান্না পেয়েছিলো সেদিন!
বাসায় চাল নেই,
পরীক্ষার ফিস নেই,
মেয়ের ঔষধ নেই,
তবুও বাবা নির্বিকার!
সদা হাসি তার মুখে।
মাঝে-মাঝে ভাবতাম বাবা কেন ভিসুভিয়াস হয়ে ওঠেন না?
লাভা স্রোতে কেন ভাসান না পৃথিবী!
কিংবা নরম্যান ফেইস;
পরিবারের জন্য যে মেরে ফেলবে গোটা দশেক নাৎসি!
আর এতো কিছু না পারলে অন্তত জেমস মরিস
মতো তো হতে পারেন!
জীবন নামক কবিতা লিখতে না পরার কষ্টে
পরিবারের সবাইকে খুব সহজে খাইয়ে দিবেন বিষ।

বাবার জীবন তো মরিসের মতো,
শুধু পতন আর পতন!
বাসায় চাল নেই,
পরীক্ষার ফিস নেই,
মেয়ের ঔষধ নেই।
উফ! সেকি অসহ্য যন্ত্রনা বাবা কি কখন বুঝতেন না?
তিনি কি কখনো দেখতে পেতেন না
তার ছেলে-মেয়ে ঈদে পোষাক কিনতে পারছে না,
হাসতে পারছে না,
গাইতে পারছে না।
হয়তো বুঝতেন…
তাই চাঁদ রাতে নিয়ে যেতেন মার্কেটে।
হাসি মুখে পূরণ করে দিতেন আটপৌরে আবদার গুলি।
পরীক্ষার ঠিক আগ মূর্হুতে দিয়ে দিতেন ফিস।
আমার জন্য গেঞ্জি-প্যান্ট, বোনের জন্য ফ্রক,
মায়ের জন্য শাড়ী সব হয়ে যেত তার হাতের অল্প টাকায়।
সব কিনা হয়ে গেলে মা বলতেন তোমার জন্য কিছু কিনবে না?
বাবা বুক পকেটে হাত দিয়ে কি যেন চিন্তা করে সেই
চিরপরিচিত হাসিটা দিয়ে বলতেন-“গতবার তো কিনলাম!
এবার বরং একটা রুমাল কিনি।
আগের রুমালটা বড্ড নরম হয়ে গেছে।
ছিঁড়ে যাবে যে কোন মূর্হুতে!”

আমার রাগ লাগতো, প্রচণ্ড রাগ লাগতো।
কেন বাবা কিছু কিনছেন না।
সেই আগের মতো এবার ঈদেও
একই পুরানো রং যাওয়া ময়লা পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরে বেরাবেন।
পান চিবুবেন আর হাসবেন।
উফ! এটা যে কতো অসহ্যকর!
বাবা কি তা বুঝেন না?
ঐ পাঞ্জাবীতে তাকে বিশ্রী লাগে তা কি তিনি জানেন না?
কিন্তু কি এক ঢং তার;
প্রতিবার… প্রতিবার ঈদে ঘাম মুছার জন্য এতো
রুমালের কি প্রয়োজন।
কিন্তু বাবা নির্বিকার,
ঠোঁটে সেই পরিচিত হাসি।

বাবা কবিতা বোঝেন না,
রবীন্দ্র জীবন নজরুল রুদ্র পড়েন না
মার্কস লেনিন চে’কেও চেনেন না।
তিনি শুধু জানেন,
ঘরে চাল নেই,
ডাল নেই,
তেল নেই,
ছেলের পরীক্ষার ফিস নেই,
মেয়ের ঔষধ নেই।
শুধু নেই আর নেই।
তারপরও কিছু বলেন না,
শুধু হাসেন আর ঘাম মোছেন।
আজ এতোটা বছর পর,
দীর্ঘ এতোটা বছর পর- এসে বুঝেছি আমার বাবা
একজন লড়াকু।
একজন প্রকৃতি যোদ্ধা!
একজন বিপ্লবী!

যোদ্ধা বা বিপ্লবী হতে হলে সব সময় অস্ত্র হাতে নিতে হয় না।
একা একটি পরিবারকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিরবে
লড়ে গেছেন অনন্তকাল।
রিক্সায় না চড়ে বৃষ্টি-রোদে পথে পথে হেঁটে
বেড়িয়েছেন অন্নের সন্ধানে।
একজন বিপ্লবী মানুষের জন্য লড়ে,
বাবা লড়েছেন আমাদের জন্য।
দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য,
পরীক্ষার ফিসের জন্য,
মেয়ের ঔষধে জন্য।
বিশ্বাস করুন দীর্ঘ এতোটা বছর পর চে, লেনিন,
মার্কস এদের কাউকে আর্দশ মানি না।
বাবাকে আর্দশ মানি; শুধু আমার বাবাকে।

আমি হিমালয় এর উচ্চতা জানি না
জানার চেষ্টাও করি না।
কিন্তু আমার বাবার উচ্চতা জানি পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি!
কিন্তু তার ছোট্ট দেহের ভিতরে যে এক আস্ত
হিমালয় আমাদের আগলে রেখেছে তাকে জানি।
তার কথার প্রতিটি শব্দ অমৃত বলে মানি।
বাবা প্রায় বলেন― “ক্রোধ দেখাতে নেই।
ক্রোধ পুষে রাখতে হয়।
নিজের ভিতরে লড়তে হয়। হারতে হয়।
মানুষের হাজার কথার বিনিময়ে শুধু তুমি হাসি দিও।
দেখবে তুমি জিতেছ!”

এবার বাবাকে বলা দরকার,
মানুষের হাজার কথায়,
তার মতো হাসতে শিখেছি;
কিন্তু হাসিটা যদিও এতো পবিত্র না।
বাবার ঘামে ভেঁজা রুমাল,
গভীর চোখ আর র্নিভেজাল হাসি,
আজও রপ্ত করতে পারিনি।
জানি বাবাকে এসব বললে আবার হাসবেন নির্বিকারভাবে―
ঠিক ঈশ্বরের মতো!
—————————-
রচনাকাল: ১৭ জুন ২০১৬

আবৃত্তি: মাহবুব রহমান (নোটিশ বোর্ড)

Error: View e71e7f42sf may not exist

Loading

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *